সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথিত কটূক্তির জের ধরে বুধবার সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁওয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি মন্দির ও বাড়িঘরে ভাংচুর এবং লুটপাটের যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। এর আগে বিভিন্ন বছরে রামু, সাঁথিয়া, নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লী, গঙ্গাচড়ার ঠাকুরপাড়া গ্রামে মন্দির ও সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা যে ‘ছকে’ ঘটেছিল, নোয়াগাঁও এরই পুনরাবৃত্তি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের আগে এ ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনায় আমরা সত্যি দুঃখিত। এ ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে। জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’ আমাদের সুনামগঞ্জ সংবাদদাতা ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করে রিপোর্টে লিখেছেন, হেফাজত নেতা মামুনুল ইসলাম দিরাইয়ের সমাবেশে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শাল্লা উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের ঝুমন দাস মামুনুলের বিরুদ্ধে পোস্ট দেন ফেসবুকে। এরপরই হেফাজতের অনুসারীরা তাকে হুমকি-ধমকি দিতে থাকে। গ্রামবাসী আসন্ন বিপদ আঁচ করতে পেরে নিজেরাই পুলিশ ডেকে নিয়ে ঝুমন দাসকে তাদের হাতে তুলে দেন। কিন্তু তারপরও বর্বরোচিত হামলার ঘটনা ঘটল। র্যাব হেডকোয়ার্টার থেকে জরুরী ভিত্তিতে সুনামগঞ্জের শাল্লায় এসে র্যাবের মহাপরিচালক নোয়াগাঁও গ্রামে দুর্বৃত্তদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর পরিদর্শন শেষে সাংবাদিক সম্মেলন করেন। তিনি বলেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে যারা ভাংচুর করেছে তাদের রক্ষা নেই। সরকার যখনই এমন ঘটনা ঘটেছে দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের এদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সারাবিশ্বে নজির স্থাপন করেছে। হাজার বছর ধরে নানা জাতি-ধর্মের মানুষ এই ভূখণ্ডে শান্তিপূর্ণভাবে মিলেমিশে বসবাস করে আসছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এ দেশের সুমহান ঐতিহ্য। বাংলাদেশের প্রাথমিক পরিচিতি মূলত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে। এ দেশের মানুষ নিজ নিজ ধর্মে নিষ্ঠাবান হওয়ায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে তারা অনুকরণীয় আদর্শ বলে বিশ্বাস করে। বাংলাদেশের মানুষ ধার্মিক বলেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহনশীলতার আদর্শ এ দেশে মূর্তমান। দেশের সিংহভাগ মানুষ ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও বকধার্মিক ও কাণ্ডজ্ঞানহীনদের কারণে কখনও কখনও তাদের সুনামও কণ্টকিত হয়ে ওঠে। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তানসহ বহু দেশে সংখ্যালঘুরা যেভাবে নির্যাতন, নিপীড়ন ও হয়রানির শিকার হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে হিসেবে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত বটে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে সম্মিলিতভাবে অটুট রাখতে হবে। ইসলাম বিশ্ব মানবতার ধর্ম, কল্যাণ ও শান্তির ধর্ম। এ ধর্ম কখনই অন্য ধর্মের উপাসনালয় কিংবা বাড়িঘরে হামলা করার অনুমোদন দেয় না। বরং ইসলামী রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইসলাম কখনও কোন ধরনের সহিংসতা, হানাহানি ও অন্যায় কর্মকাণ্ড সমর্থন করে না। তবে এ দেশে বকধার্মিক, ধর্মান্ধ, ধর্ম ব্যবসায়ী, কূপমণ্ডুকদের তৎপরতা নানা সময়ে দেখা গেছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেশের ঐতিহ্যের অংশীদার বেশ কিছু মূল্যবান স্থাপনাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমরা আবারও বলতে চাই, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই। এ ধরনের ঘটনাকে প্রতিহত করার জন্য প্রশাসনের আরও সক্রিয়তা দরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসতি ও মন্দির এলাকার নিরাপত্তায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সাম্প্রদায়িক ও অশুভ শক্তিকে পরাভূত করে এই বাংলাদেশ, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর রক্তস্নাত এ দেশে তাদের কালো ছায়া কোনভাবেই আমরা দেখতে চাই না।
Leave a Reply